বাংলায় ইংরেজ শাসনের সূচনাপর্ব (অষ্টম অধ্যায়)

নবম-দশম শ্রেণি (মাধ্যমিক) - বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা - | NCTB BOOK
3k
3k

প্রাচীনকাল থেকে ভারত উপমহাদেশ - বিশেষ করে বাংলা অঞ্চল ছিল ধনসম্পদে পূর্ণ রূপকথার মতো একটি দেশ । এ অঞ্চলের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামে মানুষের জীবনযাপনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন সবই তখন পাওয়া যেত । এই স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামের কৃষকের ক্ষেতভরা ফসল, গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ থাকত। কুটির শিল্পেও গ্রাম ছিল সমৃদ্ধ । তাঁতিদের হাতে বোনা কাপড় ইউরোপের কাপড়ের চেয়েও উন্নতমানের ছিল । এর মধ্যে জগৎ বিখ্যাত ছিল মসলিন কাপড়। তাছাড়া উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলও নানা ধরনের বাণিজ্যিক পণ্য ও মসলার জন্য বিখ্যাত ছিল। এসব পণ্যের আকর্ষণেই অনেকেই এদেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে এসেছে । ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিও উপমহাদেশে এসেছিল ব্যবসায়-বাণিজ্য করতে। পরবর্তী সময়ে তারা এদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়। এদেশে আগত অন্যান্য ইউরোপীয় কোম্পানিকে পরাজিত করে এবং স্থানীয় শাসকদের বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্র করে কীভাবে ইংরেজ ব্যবসায়ী কোম্পানি এ অঞ্চলে ইংরেজ শাসনের সূচনা করে, বর্তমান অধ্যায়ে সে বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

 

এই অধ্যায় শেষে আমরা-

  • বাংলায় ইংরেজ শাসনের পটভূমি ব্যাখ্যা করতে পারব;
  • পলাশি ও বক্সারের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল মূল্যায়ন করতে পারব; 
  • ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠায় দিওয়ানি লাভের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে পারব;
  •  চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পটভূমি ও ফলাফল ব্যাখ্যা করতে পারব;
  • ইংরেজ শাসনের ফলে বাংলায় রাজনৈতিক পরিবর্তনসমূহ অনুধাবনে সক্ষম হব ।
common.content_added_by

# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন

নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং প্রশ্নের উত্তর দাও

একজন ঠকবাজ লোক এক বোকা লোকের সাথে বন্ধুত্ব করে একা গাভী পালনের উদ্যোগ নেয়। ঠকবাজ লোকটি বোকা লোকটিকে বলে তুমি গাভীর কোন দিকটা নিবে মাথার দিক না পেছনের দিক। বোকা লোকটি গাভীর পেছনের দিকে ময়লা দেখে মাথার দিকটা নেয়। এখন বোকা লোকটি কঠোর পরিশ্রম করে গাভীকে খাবার দেয় পক্ষান্তরে, চালাক লোকটি প্রতিদিন বালতি ভরে দুধ নিয়ে বাড়ি যায়।

নিচের অনুচ্ছেদটি পড় এবং প্রশ্নের উত্তর দাও

লতিফ তালুকদারের কোনো পুত্র সন্তান না থাকায় তার কনিষ্ঠ মেয়ের পুত্র ফরহাদকে পরবর্তী তালুকদারের জন্য মনোনীত করেন। যথারীতি লতিফ তালুকদারের মৃত্যুর পরে ফরহাদ অত্র এলাকার তালুকদার হয়। কিন্তু এ বিষয়টি তার বড় খালা বিউটি মেনে নিতে পারে নি। তিনি অন্য এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে হাত মিলিয়ে ফরহাদকে পরাজিত ও নিহত করেন। ফলে অত্র এলাকাবাসী স্বাধীনতা হারায়।

ইউরোপীয়দের আগমন

5k
5k

সপ্তম শতক থেকে এ অঞ্চলের সঙ্গে আরব বণিকদের ব্যবসায়-বাণিজ্য ছিল একচেটিয়া । তারা বাণিজ্য করত মূলত সমুদ্রপথে। ১৪৫৩ সালে কন্সস্টান্টিনোপোল উসমানীয় তুর্কিরা দখল করে নেয় । ফলে উপমহাদেশের সাথে জলপথে ব্যবসায়-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায় । সুতরাং প্রাচ্যের সাথে পাশ্চাত্যের ব্যবসায় - বাণিজ্যের জন্য ভিন্ন জলপথ আবিষ্কারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মূলত এ কারণেই ইউরোপীয় শক্তিগুলো সমুদ্রপথে উপমহাদেশে আসার অভিযান শুরু করে ।

 

পর্তুগিজ:

পর্তুগিজদের মধ্যে যে দুঃসাহসী নাবিক প্রথম সমুদ্রপথে এদেশে আসেন, তাঁর নাম ভাস্কো-ডা-গামা । তিনি ১৪৯৮ সালের ২৭শে মে ভারতের পশ্চিম-উপকূলের কালিকট বন্দরে এসে উপস্থিত হন। উপমহাদেশে তাঁর এ আগমন ব্যবসা-বাণিজ্য এবং যোগাযোগ ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করে । পর্তুগিজরা ব্যবসায়-বাণিজ্যের উদ্দেশে এদেশে আসে কিন্তু ক্রমে তারা সাম্রাজ্য বিস্তারের দিকে ঝুঁকে পড়ে । স্বল্প সময়ের মধ্যে এই ইউরোপীয় বণিকরা উপমহাদেশের পশ্চিম উপকূলের কালিকট, চৌল, বোম্বাই, সালসেটি, বেসিন, কোচিন, গোয়া, দমন, দিউ প্রভৃতি বন্দরে কুঠি স্থাপন করতে সক্ষম হয় ।

১৫৩৮ সালে তারা চট্টগ্রাম ও সাতগাঁওয়ে বাণিজ্যঘাঁটি নির্মাণের অনুমতি লাভ করে। ১৫৭৯ সালে হুগলী নামক স্থানে তারা উপনিবেশ গড়ে তোলে। এরপর তারা উড়িষ্যা এবং বাংলার কিছু অঞ্চলে বসতি সম্প্রসারণ করতে সক্ষম হয় । বাংলাসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা থাকলেও পর্তুগিজদের বিভিন্ন অপকর্ম ও দস্যুতার কারণে বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান তাদের চট্টগ্রাম ও সন্দ্বীপের ঘাঁটি দখল করে বাংলা থেকে বিতাড়ন করেন। তাছাড়া পর্তুগিজরা এদেশে আগত অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির সঙ্গেও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত হয় । ফলে এরা এ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় ।

 

ওলন্দাজ বা ডাচ:

হল্যান্ডের অধিবাসী ওলন্দাজ বা ডাচরা 'ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' গঠন করে বাণিজ্যিক উদ্দেশে ১৬০২ সালে এই উপমহাদেশে আসে । ভারতবর্ষে তারা কোম্পানির সনদ অনুযায়ী কালিকট, নাগাপট্টম, বাংলার চুঁচুড়া ও বাঁকুড়ায় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। তাছাড়া বালাসোর, কাশিমবাজার এবং বরানগরেও তারা কুঠি স্থাপন করে । ওলন্দাজ ও অপর ইউরোপীয় শক্তি ইংরেজদের মধ্যে ব্যবসায়-বাণিজ্য নিয়ে বিরোধ শুরু হয় এবং একই সঙ্গে বাংলার শাসকদের সঙ্গে তারা বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। ১৭৫৯ সালে সংঘটিত বিদারার যুদ্ধে তারা ইংরেজদের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ফলে ১৮০৫ সালে তারা সকল বাণিজ্য কেন্দ্র গুটিয়ে ভারতবর্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য হয় । প্রথমে পর্তুগিজ পরে ওলন্দাজ শক্তির পতন, ভারতে ইংরেজ শক্তির উত্থানের পথ সুগম করে।

 

দিনেমার:

দিনেমার বা ডেনমার্কের অধিবাসী একদল বণিক বাণিজ্য করার উদ্দেশে ‘ডেনিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি' গঠন করেন । ১৬২০ সালে তারা দক্ষিণ ভারতের তাঞ্জোর জেলায় ত্রিবাঙ্কুর এবং ১৬৭৬ সালে বাংলার শ্রীরামপুরে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। কিন্তু এদেশে তারা লাভজনক ব্যবসায় করতে ব্যর্থ হয় । ১৮৪৫ সালে ইংরেজদের কাছে বাণিজ্য কুঠি বিক্রি করে কোনো রকম বাণিজ্যিক সফলতা ছাড়াই দিনেমাররা এদেশ ত্যাগ করে ।

 

ইংরেজ:

সমুদ্রপথে ইউরোপীয় বণিকদের সাফল্য, প্রাচ্যের ধন-সম্পদের প্রাচুর্য, ইংরেজ বণিকদেরকেও এ অঞ্চলে ব্যবসায়-বাণিজ্যে উৎসাহিত করে । এই উদ্দেশে ইংল্যান্ডের একদল বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নামে একটি বণিক সংঘ গড়ে তোলে । বণিক সংঘটি ১৬০০ সালে রানি এলিজাবেথের কাছ থেকে ১৫ বছর মেয়াদি প্রাচ্যে একচেটিয়া বাণিজ্য করার সনদপত্র লাভ করে । এই সনদপত্র নিয়ে কোম্পানির প্রতিনিধি বাণিজ্যিক সুবিধা লাভের আশায় আকবরের দরবারে হাজির হন । এরপর ক্যাপ্টেন হকিন্স ১৬০৮ সালে রাজা প্রথম জেমসের সুপারিশপত্র নিয়ে বাণিজ্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সম্রাট জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর অনুমতি নিয়ে ১৬১২ সালে সুরাটে বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয়। পরবর্তীকালে ১৬১৫ সালে প্রথম জেমসের দূত হয়ে জাহাঙ্গীরের দরবারে আসেন স্যার টমাস রো । সম্রাটের কাছ থেকে তিনি ইংরেজদের জন্য বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নেন । ১৬১৯ সালে তিনি ভারতবর্ষ ত্যাগ করেন । ইতোমধ্যে কোম্পানি সুরাট, আগ্রা, আহমেদাবাদ প্রভৃতি স্থানে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে তাদের ভিত্তি মজবুত করে।

কোম্পানি দ্বিতীয় বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে মসলিপট্টমে। এরপর বাংলার বালাসোরে আরেকটি বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। তাদের শক্তি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকলে এরা করমণ্ডল (মাদ্রাজ শহর) উপকূলে একটি দুর্গ নির্মাণ করতে সক্ষম হয় । বাংলার সুবাদার শাহ সুজার অনুমোদন লাভ করে তারা ১৬৫৮ সালে হুগলিতে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে । এভাবে কোম্পানি কাশিমবাজার, ঢাকা, মালদহেও বাণিজ্য কুঠি নির্মাণ করে ।
১৬৬৮ সালে ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লস পর্তুগিজ রাজকন্যা ক্যাথারিনের সঙ্গে বিয়ের যৌতুক হিসেবে লাভ করেন বোম্বাই (বর্তমানে মুম্বাই) শহর । অর্থাভাবে চার্লস ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ডের বিনিময়ে শহরটি বিক্রি করে দেন। পরবর্তীকালে এই বোম্বাই শহরই কোম্পানির প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয় ।

জব চার্নক নামে আরেকজন ইংরেজ ১৬৯০ সালে ১২০০ টাকার বিনিময়ে কোলকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর নামে তিনটি গ্রামের জমিদারিস্বত্ব লাভ করেন । ভাগীরথী নদীর তীরের এই তিনটি গ্রামকে কেন্দ্র করেই পরবর্তীকালে কোলকাতা নগরীর জন্ম হয়। এখানেই কোম্পানি ১৭০০ সালে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় উইলিয়ামের নাম অনুসারে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ নির্মাণ করে। ধীরে ধীরে এটি ইংরেজদের বাণিজ্যিক স্বার্থ রক্ষা এবং রাজনৈতিক স্বার্থ বিস্তারের শক্তিশালী কেন্দ্রে পরিণত হয় ।

ইংরেজ কোম্পানির ক্ষমতা আরো বৃদ্ধি পায় যখন দিল্লির সম্রাট ফাররুখশিয়ার তাদের বাংলা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের অধিকার প্রদান করেন। একই সঙ্গে নিজস্ব মুদ্রা প্রচলনের অধিকারও কোম্পানি লাভ করে । সম্রাটের এই ফরমানকে ইংরেজ ঐতিহাসিক ওরমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মহা সনদ বা ম্যাগনা কার্টা বলে উল্লেখ করেন । এই অধিকার লাভ করে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অপ্রতিরোধ্য গতিতে অগ্রসর হতে থাকে ।

 

ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি:

উপমহাদেশে সর্বশেষে আগত ইউরোপীয় বণিক কোম্পানি হচ্ছে ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি । ১৬৬৪ সালে এই বাণিজ্যিক কোম্পানি গঠিত হয়। ১৬৬৮ সালে কোম্পানি সর্বপ্রথম সুরাট এবং পরের বছর মুসলিপট্টমে বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। ১৬৭৩ সালে পন্ডিচেরিতে ফরাসি উপনিবেশ গড়ে ওঠে ১৬৭৪ সালের পর থেকে তারা তাদের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বাংলায় সম্প্রসারিত করে । কোম্পানি বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খানের কাছ থেকে গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত চন্দননগর নামক স্থানটি কিনে নেয় । ১৬৯০ থেকে ১৬৯২ সালের মধ্যে চন্দননগর একটি শক্তিশালী সুরক্ষিত ফরাসি বাণিজ্য কুঠিতে পরিণত হয় । ১৬৯৬ সালে কোম্পানি এখানে একটি শক্তিশালী দুর্গ স্থাপন করতে সক্ষম হয় । নির্দিষ্ট হারে শুল্ক প্রদানের শর্তে ১৬৯৩ সালে ফরাসিরা বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে । পরবর্তীকালে তারা কাশিমবাজার বালাসোরে কুঠি স্থাপন করতে সক্ষম হয় ।

ইংরেজ বণিকরা যখন ব্যবসায়-বাণিজ্যে দৃঢ় অবস্থানে, তখন ফরাসিরা এদেশে আসে। এ অবস্থায় ইংরেজদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কারণ অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তির মতো ফরাসিরাও এদেশে সাম্রাজ্য স্থাপনের স্বপ্ন দেখতে থাকে । ফলে দুই ইউরোপীয় শক্তি— ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায় । ইংরেজদের ষড়যন্ত্র, কুটকৌশল, উন্নত রণকৌশলের কাছে ফরাসিরা পরাজিত হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ফরাসিরা বাংলার নবাবকে সমর্থন দেয়। কিন্তু এই যুদ্ধে ইংরেজদের সাফল্য ফরাসিদের আরও বিপর্যস্ত করে ফেলে। ফলে বাংলার ফরাসি বাণিজ্য কুঠিগুলো ইংরেজদের দখলে চলে যায়। দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটকের যুদ্ধসমূহে ফরাসি কোম্পানি পরাজিত হলে তারা এদেশ ত্যাগ করে। ফলে ইংরেজরা ভারতবর্ষে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তিতে পরিণত হয়।

common.content_added_by

পলাশির যুদ্ধ

845
845

১৭৪০ থেকে ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত আলীবর্দি খান বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব ছিলেন । প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তিনি সফলভাবে রাজ্য শাসন করেছেন । তিনি তাঁর সময়ে মারাঠা ও বর্গিদের দমন করে রাখতে সক্ষম হন। সুকৌশলে ইংরেজ বণিক কোম্পানিকেও নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন । কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর বাংলার রাজনীতিতে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় । নবাব মৃত্যুর আগে তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা আমেনা বেগমের পুত্র সিরাজউদ্দৌলাকে বাংলার সিংহাসনের উত্তরাধিকার মনোনীত করে যান । ১৭৫৬ সালে আলীবর্দি খানের মৃত্যু হলে তাঁর প্রিয় দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা মাত্র ২২ বছর বয়সে নবাবের ক্ষমতা গ্রহণ করেন। সিংহাসনে বসার পর থেকে তাকে নানামুখী ষড়যন্ত্র ও সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। তাঁর প্রথম সমস্যা ছিল পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের ষড়যন্ত্র । বিশেষ করে আলীবর্দি খানের তিন কন্যার মধ্যে জ্যেষ্ঠ কন্যা ঘসেটি বেগম সিরাজ নবাব হওয়ায় আশাহত হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। এদের সঙ্গে যোগ দেন ঘসেটি বেগমের দেওয়ান রাজা রাজবল্লভ, পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা সিরাজের খালাতো ভাই শওকত জঙ্গ এবং অন্যরা। কৌশলে নবাব ঘসেটি বেগমকে নজরবন্দী করেন । পূর্ণিয়ার শাসনকর্তা শওকত জঙ্গ বিদ্রোহী হয়ে উঠলে সিরাজউদ্দৌলা এক যুদ্ধে তাকে পরাজিত ও নিহত করে পূর্ণিয়া দখল করে নেন।

নবাব পারিবারিক ষড়যন্ত্র কৌশলে দমন করলেও তাঁর বিরুদ্ধে বাইরে ষড়যন্ত্রের আরেক জাল বিস্তৃত হতে থাকে । এর সঙ্গে জড়িত হয় দেশি-বিদেশি বণিক শ্রেণি, নবাবের দরবারের প্রভাবশালী রাজন্যবর্গ ও অভিজাত শ্রেণি, নবাবের সেনাপতি মীর জাফরসহ আরো অনেকে। প্রত্যেকে যার যার স্বার্থ উদ্ধারের জন্য নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে । এই ষড়যন্ত্রকারীরা পলাশি যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করতে থাকে।

 

পলাশি যুদ্ধের কারণ:

ইতিহাসের যেসব ঘটনা একটি দেশের জনগণের ভাগ্যে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটাতে পারে, পলাশির যুদ্ধ এ অঞ্চলের জনগণের জন্য তেমনি এক ঘটনা ছিল। এই ঘটনার পেছনের কারণগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

  • সিরাজউদৌল্লা বাংলার সিংহাসনে বসার পর প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ইংরেজরা নতুন নবাবকে কোনো উপঢৌকন পাঠায়নি এবং তাঁর সঙ্গে কোনো সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎও করেনি । ইংরেজদের এই অসৌজন্যমূলক আচরণে নবাব ক্ষুব্ধ হন ।
  • নবাবের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তারা কলকাতায় দুর্গ নির্মাণ অব্যাহত রাখে।
  • ইংরেজ কোম্পানি দস্তকের অপব্যবহার করলে দেশীয় বণিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকেন। নবাব দস্তকের অপব্যবহার করতে নিষেধ করেন এবং বাণিজ্যিক শর্ত মেনে চলার আদেশ দেন। কোম্পানি নবাবের সে আদেশও অগ্রাহ্য করে ।
  • আলীবর্দি খানের সঙ্গে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে ইংরেজরা নবাবকে কর দিতে অস্বীকৃতি জানায় । তাছাড়া জনগণকে নির্যাতন করার মতো ধৃষ্টতাও তারা দেখাতে থাকে ।
  • রাজা রাজবল্লভের পুত্র কৃষ্ণদাস তার পরিবারের সদস্যদেরসহ প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে কলকাতায় ইংরেজদের কাছে আশ্রয় নেন। তাকে ফেরত দেয়ার জন্য নবাব ইংরেজদের নিকট দূত পাঠান । ইংরেজ গভর্নর নবাবের দূতকে অপমান করে তাড়িয়ে দেন। এর আগে শওকত জঙ্গের বিদ্রোহের সময়ও ইংরেজরা নবাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের সমর্থন দেয় ।

ইংরেজদের একের পর এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও অবাধ্যতা নবাবকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ১৭৫৬ সালের জুন মাসের শুরুতে নবাব কোলকাতা দখল করে নেন। যাত্রাপথে তিনি কাশিম বাজার কুঠিও দখল করেন। নবাবের অতর্কিত আক্রমণে ইংরেজরা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ ত্যাগ করে পালিয়ে যায় । হলওয়েলসহ বেশকিছু ইংরেজ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে নবাবকে হেয় করার জন্য হলওয়েল এক মিথ্যা প্রচারণা চালায় যা ইতিহাসে 'অন্ধকূপ হত্যা' নামে পরিচিত। এতে বলা হয় যে, ১৮ ফুট দৈর্ঘ্য ১৪.১০ ফুট গ্রন্থ ছোট একটি ঘরে ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দি করে রাখা হয় । এতে প্রচণ্ড গরমে শাসরুদ্ধ হয়ে ১২৩ জনের মৃত্যু হয়। এই মিথ্যা প্রচার মাদ্রাজ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। ফলে উত্তেজিত হয়ে কোলকাতা দখল করার জন্য ওয়াটসন ও ক্লাইভ মাদ্রাজ থেকে কোলকাতায় চলে আসে। তারা নবাবের সেনাপতি মানিকচাঁদকে পরাজিত করে কোলকাতা দখল করে নেয়। নবাব তাঁর চারদিকে ষড়যন্ত্র ও শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে ইংরেজদের সঙ্গে নতজানু ও অপমানজনক সন্ধি করতে বাধ্য হন। এটি ইতিহাসে 'আলীনগর সন্ধি' নামে খ্যাত।

আলীনগর সন্ধিতে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার পর ক্লাইভের উচ্চাকাঙ্ক্ষা আরো বৃদ্ধি পায়। নবাবের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইউরোপে সংঘটিত সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অজুহাতে ইংরেজরা ফরাসিদের চদ্দনগর কুঠি দখল করে নেয় । নবাব এ অবস্থায় ফরাসিদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে ইংরেজদের শায়েস্তা করার ব্যবস্থা নেন। এতে ক্লাইভ ক্ষুব্ধ হয়ে নবাবকে ক্ষমতাচ্যুত করার বড়ষত্রে লিঙ্ক হয় । এই ষড়যন্ত্রে ক্লাইভের সঙ্গে যুক্ত হয় ব্যবসায়ী ধনকুবের জগৎ শেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, রাজা রাজকরভ, প্রধান সেনাপতি মীর জাফর প্রমুখ।

 

পলাশির যুদ্ধের ঘটনা:

পলাশির যুদ্ধ বাংলা তথা এ উপমহাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশির আমবাগানে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইতোমধ্যে রবার্ট ক্লাইভ তার অবস্থান সুদৃঢ় করে সন্ধি ভঙ্গের অজুহাতে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে । নবাবের পক্ষে দেশপ্রেমিক মীর মদন, মোহন নান এবং ফরাসি সেনাপতি সিন ফ্রে প্রাণপণ যুদ্ধ করেন। যুদ্ধে মীর মদন নিহত হন। নবাবের বিজয় আসন্ন জেনে মীর জাফর ষড়যন্ত্রমূলকভাবে যুদ্ধ থামিয়ে দেয়। মীর মদনের মৃত্যু ও মীর জাফরের অসহযোগিতা নবাবকে বিচলিত করে। নবাবের সেনাপতি মীর জাফর বুদ্ধক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অসহযোগিতা করে নীরব দর্শকের ভূমিকায় ছিল । নবাব কোরআন স্পর্শ করিয়ে শপথ নেয়ালেও মীর জাফরের ষড়যন্ত্র থামেনি। নবাবের সৈন্যরা যখন বিগ্রাম নিচ্ছে, সেই সময় মীর জাফরের ইঙ্গিতে ইংরেজ সৈন্যরা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। যার অনিবার্য পরিণতি নবাবের পরাজয় ।

 

নবাবের পতনের কারণ:

  • নবাবের সেনাপতি মীর জাফর ও তার সহযোগীদের যুদ্ধক্ষেত্রে অসহযোগিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা ।
  • নবাবের সেনাপতি থেকে সভাসদ অধিকাংশই দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে, ব্যক্তিস্বার্থকে বড় করে দেখেছে।
  • তরুণ নবাবের অভিজ্ঞতা, দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা ও দৃঢ়তার অভাব ছিল। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে দ্রুত সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে ব্যর্থতার পরিচয় দেন ।
  • সেনাপতি মীর জাফরের ষড়যন্ত্রের কথা জানা সত্ত্বেও তিনি বার বার তার ওপরই নির্ভর করেছেন ।
  • ইংরেজদের সম্পর্কে সতর্কতা, ফরাসি এবং ইংরেজদের ষড়যন্ত্র - এসব বিষয়ে আলীবর্দি খানের উপদেশ সিরাজউদ্দৌলার কাছে গুরুত্ব পায়নি ।
  • নবাবের শত্রুপক্ষ ছিল ঐক্যবদ্ধ এবং রণকৌশলে উন্নত ।
  • রবার্ট ক্লাইভ ছিল দূরদর্শী, সূক্ষ্ম ও কূটবুদ্ধিসম্পন্ন ।

 

পলাশি যুদ্ধের ফলাফল:

  • সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও মৃত্যু বাংলায় মুসলিম শাসনের অবসান ঘটায় এবং ঔপনিবেশিক শাসনের পথ সুগম করে।
  • যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা মীর জাফরকে বাংলার সিংহাসনে বসালেও তিনি ছিলেন নামেমাত্র নবাব, প্রকৃত ক্ষমতা ছিল রবার্ট ক্লাইভের হাতে ।
  • পলাশি যুদ্ধের ফলে ইংরেজরা বাংলায় একচেটিয়া ব্যবসায়-বাণিজ্যের অধিকার লাভ করে। ফরাসিরা এদেশ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয় ।
  • এ যুদ্ধের পর ইংরেজ শক্তির স্বার্থে এদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক পরিবর্তন হতে থাকে ।
  • পলাশি যুদ্ধের সুদূরপ্রসারী পরিণতি ছিল উপমহাদেশে কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠা। এভাবেই এ যুদ্ধের ফলে বাংলা তথা ভারতের স্বাধীনতা ভূলুণ্ঠিত হয়।

সুতরাং  পলাশির যুদ্ধ একটি খণ্ডযুদ্ধ হলেও বাংলা তথা উপমহাদেশের রাজনীতিতে এর গুরুত্ব অপরিসীম।

common.content_added_and_updated_by

কোম্পানির দেওয়ানি লাভ

3.7k
3.7k

১৭৬৫ সালে মীর জাফরের মৃত্যুর পর তার পুত্র নাজিম-উদ-দৌলাকে শর্ত সাপেক্ষে বাংলার সিংহাসনে বসানো হয় । শর্ত থাকে যে, তিনি তার পিতার মতো ইংরেজদের নিজস্ব পুরাতন দস্তক অনুযায়ী বিনা শুল্কে অবাধ বাণিজ্য করতে দেবেন এবং দেশীয় বণিকদের অবাধ বাণিজ্যের সুবিধা বাতিল করবেন । এ সময়ে ইংরেজ কোম্পানি মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে বাংলার রাজস্ব আদায়ের সম্পূর্ণ দায়িত্ব অর্থাৎ দেওয়ানি লাভ করে । ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভের পর ইংরেজরাই বাংলার সত্যিকার শাসকরূপে আত্মপ্রকাশ করে ।

মুর্শিদ কুলি খানের পূর্ব পর্যন্ত দেওয়ান এবং সুবেদার পদে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হতো। মুর্শিদ কুলি খান এই প্রথা ভঙ্গ করে দুইটি পদ একাই দখল করে নেন । তাঁর সময় কেন্দ্রে নিয়মিত রাজস্ব পাঠানো হলেও পরবর্তীকালে অনেকেই তা বন্ধ করে দেয় । আলীবর্দি খানের সময় থেকে একেবারেই তা বন্ধ হয়ে যায় । এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সম্রাট কোম্পানিকে বার্ষিক উপঢৌকনের বদলে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানি গ্রহণের অনুরোধ করেন । কিন্তু এই অনুরোধ কোম্পানি তখন গ্রাহ্য করেনি। বক্সারের যুদ্ধের পর ১৭৬৫ সালে ক্লাইভ দ্বিতীয়বার ভারতবর্ষে এলে পরিস্থিতি পাল্টে যায় ।

ক্লাইভ দেশ থেকে ফিরে প্রথমেই পরাজিত অযোধ্যার নবাব এবং দিল্লির সম্রাটের দিকে নজর দেন । তিনি অযোধ্যার পরাজিত নবাবের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন। বিনিময়ে আদায় করে নেন কারা ও এলাহাবাদ জেলা দুইটি। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ আদায় করেন পঞ্চাশ লক্ষ টাকা । অপরদিকে তিনি দেওয়ানি শর্ত সংবলিত দুইটি চুক্তি করেন । একটি দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে। এতে কোম্পানিকে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার দেওয়ানি দান করা হয় । এর বিনিময়ে ছাব্বিশ লক্ষ টাকা নবাব প্রতিবছর সম্রাটকে পাঠাবেন । এই টাকা নিয়মিত পাঠানোর জামিনদার হবে কোম্পানি ।

অপর চুক্তিটি হয় মীর জাফরের নাবালক পুত্র নবাব নাজিম-উদ-দ্দৌলার সঙ্গে । বার্ষিক ৫৩ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নবাব কোম্পানির দেওয়ানি লাভের সকল শর্ত মেনে নেন । এই চুক্তিদ্বয়ের ফলে কোম্পানির ক্ষমতা একচেটিয়া বৃদ্ধি পায়। নবাব তখন বস্তুত কোম্পানির পেনশনার মাত্র । সম্রাটও তাই। সমস্ত ক্ষমতা কোম্পানির হাতে । দেওয়ানি থেকে যে আয় হবে তা দিয়ে কোম্পানির যাবতীয় ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব । সুতরাং দেওয়ানির গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে হয় যে-

  •  দেওয়ানি লাভ কোম্পানির শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশাল বিজয় ।
  •  সম্রাট ও নবাব উভয়েই ক্ষমতাহীন শাসকে পরিণত হন। প্রকৃতপক্ষে তারা হয়ে যান কোম্পানির পেনশনভোগী কর্মচারী ।
  • দেওয়ানি লাভের ফলে এবং নবাব কর্তৃক প্রদত্ত শর্ত অনুযায়ী শুল্কহীন বাণিজ্যের কারণে কোম্পানির কর্মচারীরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে । তাদের অর্থলোভ দিন দিন বেড়ে যেতে থাকে । ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে দেশীয় বণিকশ্রেণি, সাধারণ মানুষ । তাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়ে ।
  •  দেওয়ানি লাভের ফলে বাংলা থেকে প্রচুর অর্থ সম্পদ ইংল্যান্ডে পাচার হতে থাকে । এর পরিমাণ এতটাই ছিল যে, এই অর্থের বলে ইংল্যান্ডের শিল্প বিপ্লবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল ।

 

common.content_added_by

দ্বৈত শাসন

3.1k
3.1k

রবার্ট ক্লাইভ দেওয়ানি সনদের নামে বাংলার সম্পদ লুণ্ঠনের একচেটিয়া ক্ষমতা লাভ করে । দিল্লি কর্তৃক বিদেশি বণিক কোম্পানিকে এই অভাবিত ক্ষমতা প্রদানে সৃষ্টি হয় দ্বৈত শাসনের । অর্থাৎ কোম্পানি লাভ করে দায়িত্বহীন ক্ষমতা, নবাব পরিণত হন ক্ষমতাহীন শাসকে । অথচ নবাবের দায়িত্ব থেকে যায় ষোলোআনা । ফলে বাংলায় এক অভূতপূর্ব প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি হয়, যার চরম মাসুল দিতে হয় এদেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীকে ।

১৭৭০ সালে (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) গ্রীষ্মকালে দেখা দেয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, যা ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। কোম্পানির মুর্শিদাবাদ প্রতিনিধি রিচার্ড বেচারের ভাষায় 'দেশের কয়েকটি অংশে যে জীবিত মানুষ মৃত মানুষকে ভক্ষণ করিতেছে তাহা গুজব নয়, অতি সত্য।' এই দুর্ভিক্ষে বাংলার জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ মৃত্যুমুখে পতিত হয় ।

১৭৬৫-৭০ সালে বার্ষিক রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ যা ছিল, দুর্ভিক্ষের বছরও আদায় প্রায় তার কাছাকাছি ছিল। ফলে চরম শোষণ-নির্যাতনে বাংলার মানুষ হতদরিদ্র ও অসহায় হয়ে পড়ে। দ্বৈতশাসন ব্যবস্থায় নবাবের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ না থাকায় প্রশাসন পরিচালনায় তিনি সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হন। সারাদেশে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। এই পরিস্থিতিতে ১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটান । তিনি হন প্রথম গভর্নর জেনারেল।

common.content_added_by

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত

6.6k
6.6k

কোম্পানির শাসন দুর্নীতিমুক্ত ও সুসংগঠিত করতে ১৭৮৬ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসকে ভারতের গভর্নর জেনারেল ও সেনাপ্রধানের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। তিনি ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বা স্থায়ী ভূমি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। ঐ বছর ২২শে মার্চ নির্দিষ্ট রাজস্ব পরিশোধের বিনিময়ে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার জমিদারদের নিজ নিজ জমির ওপর স্থায়ী মালিকানা দান করে যে বন্দোবস্ত চালু করা হয়, তাকেই 'চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলা হয়।

 

পটভূমি :

১৭৭২ সালে ওয়ারেন হেস্টিংস রাজস্ব আদায়ের জন্য পাঁচসালা বন্দোবস্ত চালু করেন । এই ব্যবস্থায় উচ্চহারে ডাক নিয়ে জমির বন্দোবস্ত নিলেও সেই অনুপাতে রাজস্ব আদায় হতো না । নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকায় জমিদাররা কৃষকদের কাছ থেকে প্রয়োজনে নির্যাতন করে অর্থ আদায় করত । অথচ কৃষকদের উন্নয়ন বা জমির উন্নয়নের প্রতি তাদের কোনো লক্ষ ছিল না। ফলে নির্যাতনের ভয়ে কৃষকরা জমি ছেড়ে পালিয়ে যেত । বছরের পর বছর জমি অনাবাদি থাকায় জমির দাম কমে যেত। এ অবস্থায় হেস্টিংস জমিদারদের সঙ্গে একসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। কিন্তু, এ ব্যবস্থায়ও সরকার, জমিদার, প্রজা- কারো কোনো ধরনের উপকার হয়নি। পরবর্তীকালে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজস্ব সমস্যা সমাধানের জন্য ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট নতুন ব্যবস্থা উদ্ভাবনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ।

১৭৮৪ সালে পিটের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট পার্লামেন্টে গৃহীত হয় ৷ বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় স্থায়ী নিয়ম-কানুন প্রবর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি রাজস্ব ব্যবস্থা চালুর জন্য কোম্পানিকে নির্দেশ দেয়া হয়। ১৭৮৯ সালে কর্নওয়ালিস জমিদারদের দশসালা বন্দোবস্ত দিতে প্রস্তুতি নেন । ইংল্যান্ডের কর্তৃপক্ষ জমিদারদের সঙ্গে বন্দোবস্তের অনুমতি প্রদান করলে কর্নওয়ালিস এই অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৭৮৯ সালে দশসালা বন্দোবস্ত চালু করেন। তবে এর সঙ্গে এই প্রতিশ্রুতিও তিনি দেন যে, কোম্পানির ডাইরেক্টর সভার অনুমোদন পেলে দশসালা বন্দোবস্তই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে পরিণত হবে। ১৭৯২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই দশসালা বন্দোবস্ত বোর্ড অব ডাইরেক্টরস কর্তৃক অনুমোদন লাভ করে। ১৭৯৩ সালের ২২শে মার্চ কর্নওয়ালিস দশসালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বলে ঘোষণা করেন ।

 

বৈশিষ্ট্য:

  • চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত জমিদারদের জমির স্থায়ী মালিকে পরিণত করে এবং জমিদাররা জমির মালিকানা স্বত্ব লাভ করে ।
  • রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দেওয়ার ফলে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানের বিনিময়ে জমিদার জমিদারি ভোগের চিরস্থায়ী অধিকার লাভ করে ।
  • এ প্রথা চালু হওয়ার ফলে জমিদারদের প্রশাসনিক ক্ষমতা বিলুপ্ত হয় । সরকার স্বয়ং শান্তি রক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে ।
  • খাজনা বাকি পড়লে জমিদারদের ভূমির কিছু অংশ বিক্রি করে রাজস্ব আদায় করার ব্যবস্থা ছিল ।

 

ফলাফল:
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাংলার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোয় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে । কর্নওয়ালিস জমিদার ছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডের মতো এদেশেও একটি জমিদার শ্রেণি গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন । কিন্তু ইউরোপ আর উপমহাদেশের আর্থ-সামাজিক কাঠামো ও তার বিকাশের ধরন এক ছিল না । ফলে বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া এ ব্যবস্থায় সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই অধিক পরিলক্ষিত হয়।

 

সুবিধা:

  • এ ব্যবস্থার প্রধান সুবিধা হচ্ছে সরকার তার আয়ের পরিমাণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয় । যে কারণে বাজেট প্রণয়ন, বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সরকারের পক্ষে সহজ হয় ।
  • চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট জমিদার শ্রেণি কোম্পানির একনিষ্ঠ সমর্থক হয়ে ওঠে । ফলে, ব্রিটিশ শাসন দৃঢ়করণ এবং দীর্ঘায়িতকরণে জমিদাররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয় ।
  • জমির ওপর জমিদারের স্থায়ী মালিকানা স্বীকৃত হওয়ার কারণে অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় নানা জনকল্যাণমূলক কাজে ব্রতী হয়। জঙ্গলাকীর্ণ জমি চাষের ব্যবস্থা করে । ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেশের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয় ।

 

ত্রুটি:

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে জমিদারের স্বার্থ সুরক্ষিত হয় । তারা ধীরে ধীরে ধনিক শ্রেণিতে পরিণত হয় । অপর দিকে জমিতে প্রজাদের পুরোনো স্বত্ত্ব সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়। ফলে জমিদার ইচ্ছে করলেই যেকোনো সময় তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ করতে পারত । প্রথম দিকে প্রজাস্বত্ব আইন না থাকায় তাদের ভাগ্যের জন্য সম্পূর্ণভাবে জমিদারের দয়ার ওপর নির্ভর করতে হতো ।

  • চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে জমির সঠিক জরিপের ব্যবস্থা না থাকায় অনেক সময় নিষ্কর জমির ওপর বেশি রাজস্ব ধার্য করা হতো । জমির সীমা নির্ধারিত না থাকায় পরবর্তীকালে মামলা বিবাদও দেখা দিত ।
  • সূর্যাস্ত আইনে নির্দিষ্ট তারিখে সূর্যাস্তের মধ্যে খাজনা পরিশোধ বিধানের কঠোরতার কারণে অনেক বড় বড় জমিদারি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ।
  • জমিদারি আয় ও স্বত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে জমিদাররা নায়েব-গোমস্তার ওপর দায়িত্ব দিয়ে শহরে বসবাস শুরু করে। এসব অনুপস্থিত জমিদারদের নায়েব-গোমস্তাদের অত্যাচারে প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে । ফলে জমির উৎপাদন কমে যেতে থাকে, গ্রামের অর্থনৈতিক অবস্থাও খারাপ হতে থাকে ।
  • উপমহাদেশে জমি ছিল আভিজাত্যের প্রতীক । ফলে নিম্নবর্গের অনেক ব্যক্তি, সাধারণ মানুষ যারা কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসায়-বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থের মালিক হন, তারা জমিদারি কিনে আভিজাত্যের মর্যাদা লাভে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। ফলে দেশীয় পুঁজি, দেশীয় শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে যায় । অপর দিকে কোম্পানিও সম্ভাব্য এদেশীয় প্রতিদ্বন্দ্বীর হাত থেকে বেঁচে যায় ।

চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে কৃষকরা সরাসরি জমিদার কর্তৃক শোষিত হতে থাকে । আবার এই জমিদার শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে গ্রামীণ সমাজে একটি শিক্ষিত শ্রেণি গড়ে উঠছিল, যারা পরবর্তী সময়ে দেশ-জাতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে ব্রিটিশ কর্তৃক সৃষ্ট জমিদার শ্রেণি যারা প্রথমদিকে ব্রিটিশ সম্রাজ্যের শক্ত ভিত ছিল, তাদেরই পরবর্তী প্রজন্ম পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ব্রিটিশ-রাজ উৎখাতের জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে । উপমহাদেশে জাতীয়বাদ বিকশিত এভাবেই হয়।

common.content_added_and_updated_by

বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪ সাল)

2.9k
2.9k

পলাশি যুদ্ধের পর মীর জাফরকে নামেমাত্র নবাব করা হয়। কিন্তু ইংরেজ যে উদ্দেশে মীর জাফরকে সিংহাসনে বসিয়েছিল, তাদের সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। নতুন নবাব কোম্পানির প্রাপ্য অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হয়ে দেউলিয়া হয়ে পড়ে । নিজের ক্ষমতা রক্ষা করতেও তাকে বার বার ক্লাইভের ওপর নির্ভর করতে হয় । আবার ক্লাইভের রাজকার্যে ঘন ঘন হস্তক্ষেপ নবাবের পছন্দ ছিল না। ইংরেজদের বিতাড়নের জন্য মীর জাফর আরেক বিদেশি কোম্পানি ওলন্দাজদের সাথে আঁতাত করে। বিষয়টি ইংরেজদের দৃষ্টি এড়ায়নি । মীর জাফরের বিরুদ্ধে অযোগ্যতা, অতিরিক্ত অর্থ প্রদানে অক্ষমতা এবং ওলন্দাজদের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় । ১৭৬০ সালে ইংরেজ গভর্নর ভান্সিটার্ট মীর জাফরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে মীর কাশিমকে শর্ত সাপেক্ষে সিংহাসনে বসান । ক্ষমতারোহণের পর মীর কাশিম স্বাধীনভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করতে চেয়েছিলেন । ফলে ইংরেজদের সাথে তাঁর যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল ।

 

বক্সারের যুদ্ধের কারণ:

মীর কাশিম একজন সুদক্ষ শাসক, দূরদর্শী রাজনীতিবিদ ও স্বাধীনচেতা মানুষ ছিলেন । তিনি তাঁর প্রজাদের কল্যাণের প্রতি সচেতন ছিলেন । তিনি চেয়েছিলেন ইংরেজদের সঙ্গে সম্মানজনক উপায়ে বাংলার স্বার্থ রক্ষা করে আর্থিক ও সামরিক দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে । এ উদ্দেশে তাঁর গৃহীত পদক্ষেপগুলোই শেষ পর্যন্ত বক্সারের যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়ায় । যেমন:

  • মীর কাশিম প্রথমে ইংরেজদের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ এবং প্রশাসনকে প্রভাবমুক্ত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেন । এ উদ্দেশ্যে তিনি রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গেরে স্থানান্তর করেন । নিরাপত্তার জন্য দুর্গ নির্মাণ ও রাজধানীর চারদিকে পরিখা খনন করেন ।
  • ইংরেজদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করা এবং সৈনিকদের ইউরোপীয় সামরিক পদ্ধতি শিক্ষাদানের জন্য দুইজন ইউরোপীয় সৈনিককে প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দান করেন ।
  • অস্ত্র-গোলাবারুদের জন্য যেন অন্যের মুখাপেক্ষী হতে না হয়, সেজন্য রাজধানীতে কামান, বন্দুক ইত্যাদি তৈরির ব্যবস্থা গ্রহণ করেন ।
  • বিহারের শাসনকর্তা রামনারায়ণ ইংরেজদের প্রতি বেশি আগ্রহ দেখালে তাকে পদচ্যুত ও তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার ব্যবস্থা করেন ।
  • ১৭১৭ সালে মুঘল সম্রাটের ফরমানে ইংরেজদের ব্যবসা করার যে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়েছিল তারা তার অপব্যবহার করে । ‘দস্তক' নামের ছাড়পত্রের অপব্যবহারের ফলে দেশি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকেন । ফলে, নবাব সবার জন্য আন্তঃবাণিজ্যে শুল্ক উঠিয়ে দেন। এজন্য ইংরেজ কোম্পানির কর্মচারীদের একচেটিয়া লাভজনক ব্যবসায় অসুবিধা হয়। এ বিষয়ে নবাব কোনোরকম আপোস করতে না চাইলে ইংরেজদের সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়ে ।
  • নবাবের গৃহীত পদক্ষেপ ছিল দেশ ও জনগণের স্বার্থে, যা ইংরেজদের স্বার্থপরিপন্থী । ফলে ক্ষুব্ধ ইংরেজরা এর প্রতিকারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল।
  • ১৭৬৩ সালে ক্ষুব্ধ হয়ে পাটনা কুঠির অধ্যক্ষ এলিস দখল করে নেয় । ফলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করা ছাড়া নবাবের আর কোনো উপায় থাকে না। মীর কাশিম সফল প্রতিরোধের মাধ্যমে এলিসকে পাটনা থেকে বিতাড়িত করেন।  ১৭৬৩ সালে কোলকাতা কাউন্সিল নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। মেজর এডামসের নেতৃত্বে প্রেরিত ইংরেজ বাহিনীর কাছে গিরিয়া, কাটোয়া ও উদয়নালার যুদ্ধে নবাব শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন ।

ইতোমধ্যে ইংরেজরা মীর জাফরকে পুনরায় বাংলার সিংহাসনে বসায় । মীর কাশিম পরাজিত হয়েও হতাশ হননি । নবাব ইংরেজদের মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন । তিনি অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং মুঘল সম্রাট শাহ আলমের সঙ্গে একত্রিত হয়ে ১৭৬৪ সালে বিহারের বক্সার নামক স্থানে ইংরেজদের বিরুদ্ধে শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন । দুর্ভাগ্যক্রমে সম্মিলিত বাহিনী মেজর মনরোর কাছে পরাজিত হয় ।

মীর কাশিমের পরাজয়ের কারণে বাংলার সার্বভৌমত্ব উদ্ধারের শেষ চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। ইংরেজ শক্তি অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাংলা তথা উপমহাদেশের সর্বত্র ক্ষমতার বিস্তার ঘটাতে থাকে । এ কারণে উপমহাদেশের ইতিহাসে পলাশির যুদ্ধের চেয়ে বক্সারের যুদ্ধের গুরুত্ব অনেক বেশি ।

 

বক্সারের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের নাম ও দেশের নাম:

            নাম                        দেশ
       মীর কাশেম               ইংল্যান্ড
     সম্রাট শাহ আলম                 বাংলা
      মেজর মনরো               অযোধ্যা
     সুজাউদ্দৌলা                   দিল্লি

 

বক্সারের যুদ্ধের ফলাফল :

১. এ যুদ্ধের ফলে মীর কাশিমের স্বাধীনতা রক্ষার শেষ চেষ্টা ব্যর্থ হয় । উপমহাদেশে ইংরেজদের প্রভাব- প্রতিপত্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায় । বিনা বাধায় তারা আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ লাভ করে ।

২. এ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা রোহিলাখণ্ডে পালিয়ে যান। দিল্লির সম্রাট শাহ আলম ইংরেজদের পক্ষে যোগ দেন । মীর কাশিম পরাজিত হয়ে আত্মগোপন করেন । ১৭৭৭ সালে তাঁর মৃত্যু হয় ।

৩. ইংরেজরা অযোধ্যার নবাবের কাছ থেকে কারা ও এলাহাবাদ হস্তগত করতে সক্ষম হয় ।

৪. এ যুদ্ধের ফলে শুধু বাংলার নবাবই পরাজিত হননি, তাঁর মিত্র ভারত সম্রাট শাহ আলম, অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলাও পরাজিত হন । এই তিন শক্তির একসঙ্গে পরাজয়ে ইংরেজদের মর্যাদা ও শক্তি বৃদ্ধি পায় ।

৫. এ যুদ্ধের ফলে রবার্ট ক্লাইভ দিল্লির সম্রাটের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করে । ফলে বাংলায় ইংরেজ অধিকার আইনত স্বীকৃত হয় এবং তারা অসীম ক্ষমতাশালী হয়ে উঠতে থাকে । শুরু হয় প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিক শাসন।

 

common.content_added_by
টপ রেটেড অ্যাপ

স্যাট অ্যাকাডেমী অ্যাপ

আমাদের অল-ইন-ওয়ান মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সীমাহীন শেখার সুযোগ উপভোগ করুন।

ভিডিও
লাইভ ক্লাস
এক্সাম
ডাউনলোড করুন
Promotion